![]() শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের উন্নয়নের চাবিকাঠি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() শিক্ষার মান উন্নয়ন ও সংস্কারের ভূমিকা সবার আগে। কিন্তু শিক্ষকের পেশা গ্রহণে যোগ্য ও মেধাবী তরুণরা আগ্রহী নন। প্রাথমিক শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পেতে শিক্ষা বিজ্ঞানে ডিগ্রি থাকা এখন আবশ্যক। শিক্ষক বা শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের জন্য এ রকম বাধ্যবাধকতা নেই। অর্থাৎ এসব পদের জন্য বিশেষায়িত জ্ঞান বা দক্ষতার প্রয়োজন নেই। শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও শিক্ষকের পেশাগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ পেশাগত প্রস্তুতি আবশ্যকীয় করা প্রয়োজন। শিক্ষার মান বৃদ্ধি এবং এটিকে ফলপ্রসূ করতে হলে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাঠের উপকরণ, বই ইত্যাদি ছাড়াও অবকাঠামো এবং শিক্ষকের সংখ্যা ও দক্ষতা বাড়াতে ব্যয় বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। দরিদ্র পরিবারের জন্য শিক্ষার ব্যয় লাঘবের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় আয় বা বাজেটের নির্দিষ্ট অনুপাতের কথা বলা হয়নি। তবে ক্রমাগত বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ানো এবং এর যথার্থ ব্যবহারের জন্য ব্যবস্থাপনাগত ও জবাবদিহির পদক্ষেপ নিতে হবে শিশুর শেখা বা দক্ষতা অর্জন সমগ্র শিক্ষা আয়োজনের সাফল্যের মাপকাঠি। এ জন্য প্রতিটি শিশুর শিক্ষার অগ্রগতির মূল্যায়ন এবং প্রতিটি বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় ব্যবস্থার কার্যকারিতার মূল্যায়ন প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে ও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর ধারাবাহিক এবং বর্ষ বা স্তর শেষে মূল্যায়ন থাকবে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে বিদ্যালয়েও মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রতি বিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীর অগ্রগতির নিরিখে লাল, হলুদ ও সবুজ হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে।বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক দল ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সম্মিলিত দায়িত্ব হবে প্রতি বিদ্যালয়কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবুজে রূপান্তরিত করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, ভৌগোলিক, ভাষাগত কারণে এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে শিক্ষায় অভিগম্যতা ও অংশগ্রহণে ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। বৈষম্যের প্রকৃতি ও পরিমাণ সব জায়গায় এক নয়। এ জন্য বিশেষ লক্ষ্য, কৌশল ও পরিকল্পনা এবং অতিরিক্ত বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষার মতো জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়ে একটি কমিটি সুপারিশ প্রদানেই সব সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা সংগত নয়। যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে যথার্থ বিবেচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পথে কীভাবে এগোনো হচ্ছে, তা শিক্ষাসমাজ ও সচেতন নাগরিকের নজরদারিতে থাকতে হবে। এ জন্য স্থায়ী উচ্চক্ষমতার শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এটির আইনি কাঠামো, সাংগঠনিক স্বরূপ, কার্যধারা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত সময়সাপেক্ষ এবং এ জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যও প্রয়োজন। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষা খাতের জন্য একটি শিক্ষা পরামর্শ পরিষদের সুপারিশ করা হয়েছে। এই পরিষদ বিভিন্ন জটিল ও সংবেদনশীল বিষয় বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের জন্য সহায়ক হতে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্নভাবে ও চাপের মুখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরিহারের জন্য এ পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে তাঁর প্রথম ভাষণে (২৫ আগস্ট) বলেছিলেন, শিক্ষায় যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করা হবে তাঁর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। কমিটির সুবিবেচিত প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। এ সম্পর্কে অনেক আশু ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বর্তমানে প্রস্তুতাধীন পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় এবং সরকারের শিক্ষা বাজেট প্রস্তাবে। আমাদের মনে রাখতেই হবে, প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই একটি শিশু লিখতে পড়তে শিখে। জীবনের মৌলিক শিক্ষার শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে। সামাজিকতা, নৈতিকতা, পরষ্পর যোগাযোগ, সহমর্মিতা এসব গুনের সাথে পরিচয় ও চর্চা হয় প্রাথমিক শিক্ষাঙ্গনেই। সার্বিক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব একটি শিশুর জন্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের ভাবতে হবে। যেমন: নৈতিকতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা একটি শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পাবে। একজন শিক্ষক তার অভিজ্ঞতা ও শিখানোর মাধ্যমেই একটি শিশুর সারা জীবনের নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে দিতে পারেন প্রাথমিক শিক্ষা জীবনেই।সামাজিকতা শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে বড় কোন কিছুই হতে পারে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসার আগে একটি শিশু কেবল তার মা-বাবা ভাই-বোন আত্নীয় স্বজনের সাথেই মিশেছে। কিন্তু বিদ্যালয়ে আসার পর সে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হচ্ছে, খেলছে, অনেকটা সময় একসঙ্গে থাকছে ফলে সামাজিকতার মহান পাঠ সে প্রাথমিক শিক্ষাতেই পেয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি শিশুর প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হলো শিক্ষা। এটি শুধুমাত্র সরকার একার দায়িত্ব নয় বরং প্রতিটি বাবা মাকেও সমানভাবে প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো, প্রতিটি শিশুর জ্ঞান বা চেতনা বৃদ্ধি করা, আত্মোন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি করা, মানসিক বিকাশ ঘটানো, স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি করা, শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে ধারনা, সর্বোপরি নৈতিক মূল্যবোধ তৈরি করা। প্রাথমিক শিক্ষা একটি শিশুর সামাজিক, মানসিক, দৈহিক, সাংস্কৃতিক, আবেগীয় বিষয় সংক্রান্ত সকল বিষয়ে শিক্ষা প্রদান করবে। উল্লিখিত বিষয় গুলোর সুশিক্ষা একটি শিশুর সারাজীবনের পথ চলার সঙ্গী হয়ে থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষা যেহেতু একটি শিশুর শিক্ষা জীবনের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, তাই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। খুব ভালো ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হলে প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমেই আমরা প্রতিটি শিশুর মনে দেশ প্রেমের বীজ বুনে দিতে পারি, প্রতিটি শিশুর মননে সততা ও নৈতিকতার বীজ বুনে দিতে পারি, প্রতিটি শিশুর অন্তরে ভালবাসার পাহাড় তৈরি করতে পারি। ভবিষ্যতে এসব বীজ বৃক্ষে পরিণত হবে, ভালবাসার এভারেস্টে পরিনত হবে, দেশ ও জাতি পাবে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে তৈরি হয়ে এলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে সেটি পরিপূর্ণভাবে বিকাশের সুযোগ মেলে। অন্যথায় ডিগ্রিধারী মানুষ তৈরি হয় সত্যি কিন্তু দক্ষ জনসম্পদে ঘাটতি বাড়তেই থাকে।সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে তাই যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত, সেটি যত দ্রুত সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত শিক্ষকরাই যেহেতু এ কাজে অন্যতম বড় ভূমিকা পালন করেন, সুতরাং তাদের কেন্দ্র করে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার প্রয়াস গ্রহণ করা হলে তার ফল ও প্রভাব দ্রুত পড়বে অন্যান্য খাতেও। শিখনের স্থায়ী ও ইতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্তিশালীকরণের বিকল্প নেই। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |