![]() রাজনীতিতে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবহেলা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() এ থেকেই বোঝা যায় যে, আইনসম্মত প্রতিবাদ গণতন্ত্রে অশ্রদ্ধেয় নয়। তাদের সম্পর্ক বৈরিতার নয়, আনুকূল্যের। কারণ, সংসদীয় আদর্শে শাসক ও বিরোধী উভয় দলই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সুতরাং, নির্বাচকদের ভালমন্দ দু’পক্ষেরই দায়িত্ব, এবং সে দায়িত্বে তারা একে অন্যের পরিপূরক।কিন্তু তাই বলে কি গণতন্ত্রে প্রতিবাদকে এতটা মূল্য দেওয়া উচিত? নিশ্চয়ই উচিত। কারণ, প্রতিবাদের অভাবে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে, এমনকি রুগ্ণ বা মুমূর্ষু অবস্থায় তা শেষ পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্রেরই কুক্ষিগত হতে পারে। তাই প্রতিবাদের কাজই হল শাসনব্যবস্থার দোষত্রুটির প্রতি শাসক দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, গণতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতিগুলি আইনসভায় ও তার বাইরে জনমতের কাছে পেশ করা, আবেদন-নিবেদন থেকে শুরু করে সব রকমের বৈধ উপায়ে গণতন্ত্রেরই স্বার্থে নাগরিক অধিকার সম্পর্কে নির্বাচকদের শিক্ষিত করা ও সজাগ রাখা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো অসংখ্য ভুল করেছে। কিন্তু তারা কখনোই তা স্বীকার করতে চায় না। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলগুলো তাদের ঐতিহাসিক ভুলে অনড়। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ দাবিদার দলগুলো সরকারে থাকাকালীন দমনপীড়ন, হামলা-মামলা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দমন করে। রাষ্ট্রীয় দুর্যোগেও ভুলের দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে এমন ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা সমাজের একাংশ বা পুরো রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এসব ভুল সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা নয়, বরং দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও জটিলতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। গত ১৫ বছরে যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তা নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে কেবল প্রতারণা নয়, রীতিমতো জনগণের ক্ষমতাকে হেয় করেছে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ যে গণবিচ্ছিন্নতার চর্চা করেছে এবং জনগণের মধ্যে বিরাগ সৃষ্টি করেছে-তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে। দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অবহেলা ভুলের রাজনীতির মূল কারণ। নেতারা নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতি, অর্থের অপব্যবহার ও বিভাজন সৃষ্টি করেন, যা জনগণের আস্থা কমায়।নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সহিষ্ণুতা ও গঠনমূলক বিতর্কের অভাবে বিভাজন বাড়ে, যা দেশের সংকটকে আরও গভীর করে তোলে। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি তাদের রাজনৈতিক ভুল ও ভুলের রাজনীতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে বলছে, অতীতের বিভাজন, বিরোধ ও প্রতিশোধের রাজনীতি শেষ করতে হবে এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। তারা বিরোধীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে না দেখে, সহযোগী হিসেবে দেখার আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে মামলার ধারা, দমন পীড়ন বা শক্তি প্রয়োগের পথ পরিহার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। বর্তমানে জনগণ সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনের দাবি করছে, যেখানে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকবে।তারা মনে করে, গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি নির্বাচন, যা দেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সহায়ক। অতীতে সহিংস রাজনীতির ফলে দেশের ক্ষতি হয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত আলোচনা ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা এবং দেশের স্বার্থে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।সব রাজনৈতিক মতাদর্শ, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি সম্মান রেখে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক দর্শন গড়ে তুলতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি, যা সবার বাংলাদেশ নির্মাণের ভিত্তি-এই ধারণাটি তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের মূল বিষয়, যা গণতন্ত্র, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক। এটি বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের পুনর্জাগরণ ও মর্যাদার ঐতিহাসিক সনদ, যা বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা এবং ভিশন ২০৩০-এ যুক্ত রয়েছে। যদিও রাজনীতিতে ভুল করেননি-এমন কোনো রাজনৈতিক নেতা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে যাঁর ভুলের পরিমাণ যত কম, তিনি তত বেশি সফল। তাঁকে জনগণ তত বেশি ভালোবেসে মনে রেখেছে। রাজনীতিতে ভুল বলতে এমন সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ বোঝায়, যা অবিবেচনা প্রসূত; বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত। আমরা গণতন্ত্রের সৌধ ভেঙ্গে পড়াকে নীরবে অবলোকন করতে পারি না, কিংবা এমন আশাও পোষণ করতে পারি না যে, শুধুমাত্র সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা মানবাধিকার রক্ষার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। আমরা যদি মানবাধিকার নিয়ে বাঁচবার মতো বাঁচতে চাই তবে মানবাধিকারের প্রবক্তাদের উক্ত ভুলের বিভ্রান্তি হতে বাহির হয়ে আসতে হবে। অকার্যকর গণতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাও চড়াই-উত্রাই পথ অতিক্রম করছে এবং আদালতের স্বাধীনতা রক্ষায় দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থাকার ভূমিকা পালন জরুরি হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র যেখানে কার্যকর, বিচার বিভাগ সেখানে স্বাধীন এবং মানবাধিকার লংঘন ঠেকানোর ব্যাপারে বিচার বিভাগ পালন করে বলিষ্ঠ ভূমিকা। মানবাধিকার এক্টিভিস্টদের সংকল্প হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মানবাধিকারের স্বার্থে দৃঢ়মূল করা।সবকিছুর সার সংক্ষেপ করে বলা যায়, আমাদের দেশের মানবাধিকারের সংকট গণতন্ত্রের চলমান সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের বিদ্যমান সহিংস রাজনীতি যেখানে জীবন হানির ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়- এটাকেই জঘন্যতম মানবাধিকার লংঘন হিসাবে দেখতে হবে। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বণ্টনের মাধ্যমে প্রতিটি পেশায় পরিকল্পিতভাবে একটি গণতন্ত্র বিরোধী কায়েমী স্বার্থচক্র গড়ে তোলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার নাম হচ্ছে দলীয়করণ। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচনী বিজয়কে কায়েমী স্বার্থের বিজয়ে পরিণত করা হয়েছে, অর্থাৎ জনগণের ভোটাধিকার অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার গদিতে কে বসেছে বা বসেনি, তার খতিয়ানই প্রতিবাদের মূল্য সম্পর্কে শেষ কথা নয়। প্রতিবাদের ভিত্তি প্রতিবাদীর আত্মশক্তিতে। প্রতিবাদ যদি ন্যায়সংগত হয়, যে-কোনও হিসেবেই তা জমা পড়বে লাভের কোটায়। আত্মশক্তি নাগরিকের বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, সকলের মঙ্গলের জন্য সমবেত উদ্যোগে মিলিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ভাবেই প্রতিবাদের মাধ্যমে আত্মশক্তি পরিণত হয় গণশক্তিতে, আর তারই ফলে গণতন্ত্রের প্রসার ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়। এবং আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ বলেই মানুষ তার মনুষ্যত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। সব জীবের মধ্যে সে যে তার মানবিক বিবেকে, শুভবুদ্ধিতে, সংকল্পে সম্পূর্ণ আর এক প্রকার সত্তা, এই চেতনার উদ্ভাসে নিজের সঙ্গে সে নিজে মুখোমুখি হয়। এ সাক্ষাৎকার কি কখনওই ক্ষতিকর হতে পারে? রাজনীতিতে ভুল ও ভুলের রাজনীতি দেশের অর্থনীতি, সমাজ এবং গণতান্ত্রিক চর্চায় ভালোমন্দের দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। তবু এ দীর্ঘ সময়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো-বিভেদ ও প্রতিহিংসা নয়, বরং সমঝোতা, গণতান্ত্রিক চর্চা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণই একটি জাতিকে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। যদি দলগুলো এই শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করতে পারে, তবে ২০৫০ সালের মধ্যেই এটি একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক ও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বে আপন স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |