![]() ভারত-বাংলাদেশ সংকটের নেপথ্যে কী আছে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() ২০০৬ সালের পরবর্তী সময় থেকে ২০২৪-এর আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৮ বছরব্যাপী বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশী দেশটির এক ধরনের প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান ছিল। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রতিটি ঘটনায় তার প্রভাব লক্ষ করা গেছে। ২১ আগস্ট ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিরোধী দলের নেতাদের ফাঁসানো, পিলখানা হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গি নাটক, আয়নাঘর ও বিডিআর বিদ্রোহ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির পেছনে এ প্রভাব অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটকে ক্ষমতায় আনা হয়। বিভিন্ন কূটনৈতিক অংশীদার ও আন্তর্জাতিক পক্ষ ক্ষমতার এ রূপান্তরের সহযোগী হওয়ায় এর অন্তর্নিহিত কারচুপি সেভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। এই মেয়াদকাল ছিল বাংলাদেশ-ভারত অধীনতামূলক সম্পর্কের রচনা বা কাঠামো তৈরির সময়কাল। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির চোখে ঢাকাকে দেখার নীতি নেয়ায় বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামোতে স্থান করে নেয়া ভারতের জন্য তেমন একটা কঠিন হয়নি। এ কাঠামো তৈরির একটি অংশ ছিল বলে মনে করা হয় পিলখানা হত্যাকাণ্ড বা বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। এ ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাবাহিনী ঢেলে সাজানো হয়। এ প্রক্রিয়া একটি রূপ পাওয়ার মধ্যে ২০১৪ সালে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আসে। আগের নির্বাচনে যেখানে একটি বৃহত্তর কূটনৈতিক সমর্থনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা সম্ভব হয়, এবার সেখানে সরাসরি ভূমিকা রাখে ভারত। আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় শেখ হাসিনা ও তার প্রতিবেশী দেশের উপদেষ্টারা বিরোধী পক্ষকে বাইরে রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরামর্শ দেয়। এ ছক অনুসারে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী পক্ষকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়। এর আগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় পক্ষের প্রভাব নিশ্চিত করতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্য বিরোধী হিসেবে পরিচিত রাজনীতিবিদদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় আন্তর্জাতিক মানের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ কালাকানুন মার্কা আইনে। এই বিচারের মনগড়া রায় তৈরি ও তা এগিয়ে নিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে তা দিয়ে রাজনীতির গতিপথ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। একে লক্ষ্য হাসিলের হাতিয়ার করার চেষ্টা হয়। এ সময় অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়। যেমন: ভারতের আধিপত্যের বিরোধিতাকারী বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রহসনের বিচার করে দুনিয়া থেকে বিদায় করা। এর মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশটি যাদের রাজনৈতিক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের দুর্বল করা। কথিত জঙ্গি নাটক তৈরি করে এ শক্তিকে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভাবে চাপে ফেলা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন অর্থনৈতিক সামাজিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো দখলে নিয়ে এ শক্তিকে কাঠামোগতভাবে দুর্বল করা। পাশাপাশি প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা খাতে নিয়ন্ত্রক প্রভাব তৈরিতে এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পদোন্নতি ও পদায়ন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর বাইরে প্রশাসনের ভিত্তি মূলক হিসেবে পরিচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হয়। ২০২৪ সালের একদলীয় নির্বাচনের পর জনসমর্থনের তোয়াক্কার প্রয়োজন না হওয়ায় এ সময় সরকারের নীতি হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতার মূল সমর্থনকারী প্রতিবেশী দেশকে খুশি করা এবং তাদের চাওয়া পূরণ করা।লক্ষণীয়,এ জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে চীন বাংলাদেশের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলেও দিল্লির বাধায় তা সীমিত থাকে। আগস্ট বিপ্লব ছিল এক কথায় দেড় দশকের নিবর্তন মূলক ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে। বিপ্লবের পরে ক্ষমতায় এসে অন্তর্বর্তী সরকার দেড় দশকের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডকে জবাবদিহির আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে রাষ্ট্র সংস্কারে প্রথমে ছয়টি ও পরে আরো পাঁচটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।জাতীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও পদক্ষেপের সুপারিশে একাধিক টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এসব জরুরি কাঠামোগত পদক্ষেপ ও নীতি গ্রহণের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশকে অস্থির করতে যেসব অন্তর্ঘাতমূলক কাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে উসকে দিয়ে বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করছে; সেগুলো মোকাবেলা করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। হত্যা, গুম, মানবাধিকার হরণ ও গণহত্যার অপরাধগুলো বিচারের আওতায় আনতে ট্রাইব্যুনালে নেয়া হয়েছে। এই বিচার এগিয়ে নিতে আইন কর্মকর্তা ও পরামর্শক নিয়োগসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।স্বৈরাচারের সাজানো প্রশাসন পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন করে সরকারের নীতি বাস্তবায়নের উপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেড় দশকে যেসব কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল তাদের মূলধারায় ফেরানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তিগুলো নতুন করে পর্যালোচনার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পতিত স্বৈরাচারী দল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো ময়দান থেকে ছিটকে পড়েছে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির জন্য অনেক অভিযুক্ত গ্রেফতার হয়ে আইনের মুখোমুখি হয়েছেন। এর সাথে ভারতের যে নিয়ন্ত্রক প্রভাব বাংলাদেশের প্রশাসনে ছিল তা কমতে শুরু করে। তাদের ১৫ বছরের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসায় জনমনে যে বিরূপ অবস্থা ছিল তা আরো তীব্র হতে শুরু করে। ফলে প্রতিবেশী দেশের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের অনেক সদস্য বাংলাদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশে প্রতিবেশী রাডার নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হতে থাকে। এ অবস্থায় কৌশল হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে প্রথমে পুলিশ-আনসার বিদ্রোহ, পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে অস্থিরতা তৈরি এবং সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলার চেষ্টা করা হয়। এসব চেষ্টা ব্যর্থ হলে সামরিক চাপ প্রয়োগের প্রচেষ্টাও নেয়া হয়। এখন নতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রভাব বিস্তার করে অন্তর্বর্তী সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব বিদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। লক্ষ্য সামনে রেখে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা এগিয়ে নিতে চাইছেন প্রতিবেশী দেশের নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, ২০২৫ সালে নির্বাচন করা হলে রাষ্ট্র সংস্কার ও ট্রাইব্যুনালে বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করা সম্ভব হবে না। এছাড়াও বৈশ্বিক জনমত বিভ্রান্ত করতে বাংলাদেশ একটি উগ্রপন্থী ইসলামী সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে বলে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকছে, যা কুয়াড, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে প্রচার করে যাচ্ছে।একই সাথে বলা হচ্ছে বাংলাদেশ পাকিস্তানের জন্য সুরক্ষিত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক চাপের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইইউ ও কুয়াডভুক্ত এবং অন্যান্য দেশের অ্যাম্বাসি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সামনে নিজেদের লোক দিয়ে বিক্ষোভ করানো হচ্ছে। কঠোর পন্থার অংশ হিসেবে ভারত তার বাংলাদেশ লাগোয়া সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে বাংলাদেশের ওপর ভীতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ ব্যাপক ভাবে মোতায়েন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ-সংলগ্ন ইন্টার্ন থিয়েটারে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অংশ হিসেবে মিসাইলের মতো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র মোতায়েন করা হচ্ছে। রাফায়েল জঙ্গিবিমান ও অন্যান্য যুদ্ধবিমান এবং অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েনের মাধ্যমে সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি এবং এ নিয়ে মিডিয়াতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশটি নিজেদের সব ধরনের এসেট ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে ফেলতে এবং পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র কার্যত অচল করে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এর ফলে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে সরকারের প্রতি অসহযোগিতার প্রবণতা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা সৃষ্টি করছে। প্রতিবেশী দেশের সর্বব্যাপী কৌশল মোকাবেলা করতে কাউন্টার-ইন্টেলিজেন্স জোরদার করতে হবে। তাদের গোপন কার্যক্রম শনাক্ত ও প্রতিহত করতে গোয়েন্দা ক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রোপাগান্ডা এবং ভারতের অ্যাসেট ও তাদের স্বার্থ রক্ষাকারীদের চিহ্নিত করে তা প্রতিহত করতে হবে। আন্তর্জাতিক জোট তৈরি ও পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল সব বৃহৎ আন্তর্জাতিক শক্তির সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে হবে। একই সাথে জাতিসঙ্ঘ, কুয়াড ও ইইউসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার জবাব দেয়া দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে, জাতীয় ঐক্য যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের সবচে উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত-বাংলাদেশ জনগণের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতির দিকটি।সার্বিকভাবে দুদেশের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি এখন নেতিবাচক বার্তাই দিচ্ছে। একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আমাদের জন্য দরকার একইভাবে ভারতের জন্য দরকার। কারণ বাংলাদেশকে ঘিরে তার নিরাপত্তার বিষয় আছে, তার ব্যবসা বাণিজ্য আছে, তার বিনিয়োগ আছে তার ভূরাজনীতি আছে। সবগুলো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যদি তার সঙ্গে সহযোগী না হয় বা সহযোগিতা না করে তাহলে সেগুলো ভারতের জন্যই নতুন করে জটিলতা তৈরি করবে। এই বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই দেশের নেতৃবৃন্দের এই উত্তেজনা প্রশমনে সক্রিয় হওয়া দরকার। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |