![]() রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় করতে সংস্কার জরুরি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() যদিও এর মধ্যে ভণিতা আছে।রোনাল্ড রিগ্যান অগাস্তো পিনোশের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। জো বাইডেন সৌদি আরবের সঙ্গে যেমন দূরত্ব বজায় রাখতে পারেননি, তেমনি ধর্মান্ধ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিন্দা জানাতে পারেননি। কিন্তু এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসাম্য এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে অনেকেই গণতন্ত্রকে বাতিল করে দিচ্ছেন। ২০২৪ সালের আগস্টে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার দীর্ঘস্থায়ী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।ভবিষ্যতের সরকারগুলির যেকোনো দমন-পীড়ন সহ্য করতে সক্ষম এমন দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত মার্চ মাসে মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনা যাতে অব্যাহত ভাবে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি করা যায় সংস্কারের প্রক্রিয়াকে সহযোগীতা করার জন্য এবং দাতা সরকারগুলির উচিত মূল কাঠামোগত সংস্কারের উপর জোর দেওয়া। গত ১৫ বছর ধরে, হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের সদস্যদের জোরপূর্বক গুম, বিচার বহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নজরদারি এবং নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিল। হাসিনা ক্ষমতা সুসংহত করার সাথে সাথে, তার সরকার বিচার বিভাগ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সহ তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখার ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর তত্ত্বাবধান এবং জবাবদিহিতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠানগুলিকেও দুর্বল করে দিয়ে ছিল। একজন পুলিশ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে, প্রায়শই লাভজনক পদের জন্য যোগ্যতার চেয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যার ফলে পুলিশ ক্রমশ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে, বছরের পর বছর ধরে দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করে। ছাত্র-জনতা হাসিনার বিদায়ের কয়েকদিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্ব সহকারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের টানাপোড়েন চলছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। প্রকাশ্যে বক্তৃতা-বিবৃতিও দিয়েছেন কেউ কেউ। আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নানা বিষয়ে মতভেদ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই সংলাপে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ইসলামী আন্দোলন, এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় পার্টি, খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ ২৭টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ রাজনীতিক অংশ নেন।সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়াও প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার এ প্রয়াসকে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় হিসেবে অভিহিত করেন। দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুরো সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি ও আলী রীয়াজকে সহসভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছিল। মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় মাস। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে না। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত নেবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চূড়ান্ত লক্ষ্য সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জুলাই সনদ তৈরি করা। তবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের কণ্ঠে ঐকমত্যের বিষয়ে আশাবাদের কথা শোনা গেলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও নির্বাচনের সময়ের বিষয়ে ভিন্নমত আছে। অনেক দল ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে।আবার কোনো কোনো দল ব্যাপকভিত্তিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচন আগে না স্থানীয় নির্বাচন আগে হবে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, শিগগিরই দল ও জোটভিত্তিক আলোচনা শুরু হবে। প্রধান উপদেষ্টা ভবিষ্যতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা আর কখনোই ফিরে না আসতে পারে। এ বিষয়ে মোটাদাগে কোনো রাজনৈতিক দলের দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। অন্তত প্রকাশ্যে সে কথা কেউ বলেননি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তর্কবিতর্ক হতে পারে, কিন্তু কতিপয় বিষয়ে তাদের একমত হতেই হবে। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য নির্বাচন যে জরুরি, এ কথা কেউ অস্বীকার করবে না। আবার ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো সুদৃঢ় করতে সংস্কারকেও অগ্রাহ্য করা যাবে না। সর্বোপরি গুরুত্বপূর্ণ হলো সংলাপের মধ্য দিয়ে যে সনদ তৈরি হবে, সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। প্রধান উপদেষ্টা যাকে জাতির সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তার সদ্ব্যবহার করা যাবে কি না, তা পুরোপুরি নির্ভর করবে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ওপর। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেবে আশা করি। স্বাধীনতার অন্যতম প্রত্যয় ছিল গণতন্ত্র। একাত্তরে পাকিস্তানি শাসকেরা জনরায় অস্বীকার করেছিল বলেই এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু গত ৫৩ বছরেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে আসতে পারেনি। নির্বাচন নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা ছিল, সব দলের অংশগ্রহণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি হবে।এ নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা তৎপরতাও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশবাসী এমন একটি নির্বাচন পেলেন, যাতে নাগরিকেরা তাঁদের প্রতিনিধি বাছাই করার যথেষ্ট সুযোগ পাননি। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতিই জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, যা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নির্বাচন-পরবর্তী বক্তব্যেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করতে চাই, নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সংকীর্ণ রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। স্বাধীনতার মূল চেতনাকে বিবেচনায় নিয়ে একটি কার্যকর ও টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে সংবিধানে বর্ণিত প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক মত ও যেকোনো ধরনের ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাক্স্বাধীনতাসহ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিরঙ্কুশ করতে হবে। আরো অনেক ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। যেমন প্রতিযোগিতার নীতিকে আরো কার্যকর করা, কর ব্যবস্থাকে আরো দক্ষ ও ন্যায্য করা এবং দুর্নীতির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সরকারি অর্থায়নের প্রয়োজন। উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে যাওয়া বিপুল সহায়সম্পত্তির ওপর উচ্চহারে করারোপের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত যেন রাষ্ট্রের জনগণের ব্যয় নির্বাহের কিছু অর্থ মেলে।সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা ভালো ফল বয়ে এনেছে। যদি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রতিযোগিতা মূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসতেন, তিনি কি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হতেন? তবে গণতন্ত্র যেন আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারে, সেজন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। এটা মানতেই হবে যে গণতন্ত্র তখনই কাজ করে যখন সমাজের প্রতি আনুগত্য ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যকে ছাপিয়ে যায়। একটি কার্যকর গণতন্ত্রে যারা ভিন্নমত পোষণ করে তাদের আইনি বৈধতাকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।নাগরিক দেশপ্রেম পুনর্জোরদারকরণ,শাসনকাজ উন্নততর ও বিকেন্দ্রীকরণ, রাজনীতিতে টাকার ভূমিকা হ্রাসকরণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের উচিত হবে সরকারকে অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনা। আমাদের এমন গণমাধ্যম থাকতে হবে যেটা গণতন্ত্রকে অবনমন নয় বরং জোরালভাবে সমর্থন করবে। এসব সংস্কারমূলক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |