![]() ভবিষ্যত গণতান্ত্রিক উত্তরণে দরকার জাতীয় ঐক্য
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়ে গেলে সব পরিবর্তন হয়ে যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মানসিকতার পরিবর্তন না আসে। ব্যক্তি, দল কিংবা প্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্রের অনুশীলন না হলে সংস্কার কাগজেই থেকে যাবে, বিশ্বের সেরা আইনও কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। জনগণকে বাদ দিয়ে ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতন্ত্রের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলেই গণতন্ত্রকে সফল করা সম্ভব। খুবই জরুরি কথা, আমরা যেন একাত্তরকে ভুলে না যাই। একাত্তরের পর থেকে গণতন্ত্রের জন্য ধারাবাহিক যে লড়াই-সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের প্রত্যেককে আমাদের মনে রাখা দরকার। সেই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, ছাত্রদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আজকে আমরা এই জায়গায় এসে পৌঁছেছি। ২৭ ডিসেম্বর ইতিহাসের উপলব্ধি থেকে নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোথায় যাবে, এটি হলো ঐক্যের জায়গা। ইতিহাসের বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিবরণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বপ্নের জায়গা নিয়ে আমাদের ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে'। সেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ বলতে যেখানে সর্বজনীন মানবাধিকার থাকবে। যেখানে সমাজের নদীভাঙনের শিকার মানুষ থেকে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী, দলিত সম্প্রদায়, বৈষম্যের শিকার নারী কিংবা ধর্মীয় চিন্তায় বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর সব অধিকার থাকবে। সংস্কার খুব বড় স্বপ্ন। তার জন্য ঐক্য দরকার।কিন্তু সংস্কারের জন্য যে সময় দরকার, সেটা জনগণ দেবে কি না। নির্বাচনেও যেতে হবে। তার আগে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে। কারণ, সর্বোত্তমটা দিতে গিয়ে উত্তমটা যাতে হারিয়ে না ফেলি।কাঠামোগত প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়ে অনেক আলোচনা হলেও, অর্থাৎ উপরিকাঠামো নিয়ে যতখানি আলোচনা হচ্ছে, এই দেশ-সমাজের ভিত্তি নিয়ে তত আলোচনা হয়নি। এই আলোচনা শোনা যায় না যে গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন কত হবে, সে ন্যায্য মজুরি কীভাবে পাবে, কৃষক ফসলের দাম পাবে কি না, এই মুহূর্তে মধ্যবিত্ত ৮০ টাকায় শাকের আঁটি কেমন করে খাবে? সেই আলোচনা আসেনি।আমরা জানি,অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সবকিছু সংস্কার করা সম্ভব নয়। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। সরকারকে সেগুলো সম্পন্ন করার সুযোগ দিতে হবে, তারপরই একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। সেই নির্বাচনের জন্য সংস্কারের যুক্তিসংগত সময় যতটুকু লাগে, অন্তর্বর্তী সরকারকে সেটি দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চিন্তার পার্থক্য থাকবেই। না হলে দেশে একটা দলই থাকত। কিন্তু কমন ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে আমরা অনেক সময় হীনম্মন্যতা দেখি। জাতির কোনো কমন ইস্যুতে ঐক্য করতে কিছু ছাড় দিতে হয়, কিছু মতের স্যাক্রিফাইস করতে হয়,সেটাতে আমাদের ছাড় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার কথা বলা হচ্ছে। কিন্ত ফ্যাসিবাদের যে রাজনীতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি, সেটাকে পুরোপুরি বিদায় জানাতে পেরেছি কি না। যারা পালিয়েছে তাদের অপতৎপরতা আছে, সেটা মোকাবিলার সক্ষমতারও একটা অনিশ্চয়তা আছে। এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়াটা ভয়াবহ ব্যাপার হবে। এ অবস্থায় সরকারকে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। তবে নির্বাচনের সময় নিয়ে কথা আছে, নির্বাচন নিয়ে এত বেশি অনিশ্চয়তা আছে বলে মনে হয় না। তবে কিছু সংস্কার সরকারকে এখনই করে ফেলা দরকার। আর সংস্কারগুলো আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে হতে হবে। বাংলাদেশে ৫৩ বছরে কিছু হয়নি, সেভাবে দৃষ্টিকোণ করলে সঠিক নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম একটি দিক আছে। সাধারণ মানুষের উদ্যমী ক্ষমতা। এই জুলাই-আগস্ট, এটা কিন্তু নামীদামি ব্যক্তিরা করেনি। নামহীন ব্যক্তিরা করেছে।গত ৫৩ বছরের প্রতিটা সন্ধিক্ষণে এই নামহীন লোকগুলোর উদ্যমী শক্তিটাই কিন্তু সামনে চলে এসেছে। যদিও রাজনৈতিক উত্তরণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচন।যেমন রাজনৈতিক উত্তরণে নতুন প্রতিযোগী তৈরির চেষ্টা চলছে। সেখানে ছাত্রদের ওই বিষয়টা জানানো খুব জরুরি যে শেষবিচারে রাজনৈতিক ময়দানে সব প্রতিযোগীকে জনগণের আস্থা অর্জন করে কিন্তু আগাতে হবে। এটা শুধু একটা সময়ের না, প্রতিনিয়ত আস্থা অর্জনের বিষয়। এবার সংস্কার প্রশ্নে পিছপা হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তাই সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবা ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি ছকে ফেলা রাজনীতিকে বদলানোর চেষ্টা করি, বৈষম্য ভাঙার কথা বলি, এই যাত্রা কোনো দিনও সহজ হবে না। খুবই কঠিন রাস্তার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে। তার জন্য আমাদের ধৈর্য রাখতে হবে। প্রথাগত বিষয়গুলো এক দিনে ভাঙা যাবে না। পরিবর্তনের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, সবাইকেই নিতে হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকাটা সেখানে অনেক বড়। শুধু কাগজে-কলমে সংস্কার করলে হবে না, এটা চর্চা করতে হবে, যাতে মানুষ সুফল পায়। কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়ে গেলে সব পরিবর্তন হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মানসিকতার পরিবর্তন না আসে। সংস্কারের প্রশ্নে সম্ভবত এখনো ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সংস্কার নিয়ে সবাই যে একমত হবেন, এমন কোনো কর্মসূচিও নেই। তাই আমরা বলি, কমপক্ষে কতটুকু সংস্কার না হলে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়।আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রের মূল হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন। যা কিছু পরিবর্তনের কথা আমরা এখন বলছি, নির্বাচনের মাধ্যমে একটা গণপরিষদ নির্বাচিত হবে। তাঁরা সংবিধান গ্রহণ করবেন অথবা পুরোনো সংবিধান পরিবর্তন করবেন। সেটা আমাদের ঐকমত্যের সাপেক্ষে হবে এটাও সত্যি। কিন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন কতোটুকু ফলপ্রসূ হবে তাও ভেবে দেখার সময় এখনই। এছাড়াও সংস্কার প্রক্রিয়ায় অর্থনীতি গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মনে করেন অনেকেই। তুলনামূলক সৎ ব্যবসায়ীদের যদি ঐক্যবদ্ধ করতে না পারি, তাহলে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে হোঁচট খেতে পারি। ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো লুটপাটের জায়গায় চলে গিয়েছিল। সংগঠনের নেতা হওয়া মানে উনি এমপি হবেন, মেয়র হবেন, না হলে ব্যাংকের মালিক হবেন। অর্থাৎ তার উন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। এই জায়গায় ভালো ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সরকারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ থাকা দরকার। ভুলে গেলে চলবে না, যাদের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আজ এখানে এসেছি, তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে। ভিন্ন বাংলাদেশ করে দেখাতে হবে, কেবল বক্তৃতায় নয়। রাজনৈতিক দলই মঞ্চে এক রকম কথা বলে, ভেতরে আরেক রকম কথা বলে। তাদের মধ্যে যখন পলিসি লেবেলে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারাকেন্দ্রিক আলোচনা হয়, সেখানে আবার তাদের সুর ভিন্ন থাকে। তাই নির্বাচনের বিষয়টা আলাপ-আলোচনার টেবিলে এনে এর সুরাহা করা খুবই জরুরী। রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি সহনশীল ও পরমতসহিষ্ণু হওয়াটাই হবে দেশের শান্তিপূর্ণ সমাধান। এখানে উল্লেখ্য যে,নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে তরুণদের ভূমিকা রাখার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। মনোনয়ন-বাণিজ্য যখন হয়, তখন রাজনীতি ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়। আমরা যদি গণতান্ত্রিক উত্তরণ চাই, পরিস্থিতির পরিবর্তন চাই, তাহলে আমাদের ও আমাদের রাজনীতিবিদদের মানসিকতা-দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে হবে। বিশেষ করে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যদি পরিবর্তন আসে, তাহলেই এর পরিবর্তন আসবে। সংস্কারের জন্য সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ রাষ্ট্রের অন্য অংশীজনদের মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন। ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদের পর রাষ্ট্রকাঠামোয় পরিবর্তন আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য পরিবর্তন আনতে হবে সংবিধানে। যাতে ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি এ দেশে না ঘটে। এজন্য যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন সেগুলোয় রাষ্ট্রের সব অংশীজনের ঐকমত্য হতে হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |