![]() সম্প্রীতির বন্ধনে বাঁধার সওগাত নিয়ে আসে ঈদ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() তাই একজন প্রকৃত আল্লাহপ্রেমিক খোদার সন্তুষ্টি লাভের সুযোগ পেলে শোকরানা আদায় করে থাকে আর ঈদ আমাদের সেই শোকরানা আদায়ের সুযোগ করে দেয়। তাই সবাই মিলেমিশে শোকরানাস্বরূপ দু রাকাত নামাজের মাধ্যমে ঈদ পালন করে মুসলিম উম্মাহ। ঈদের চাঁদ অর্থাৎ শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর তাকবির পড়তে হয়- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সব প্রশংসা আল্লাহর। এছাড়া ঈদের নামাজ পড়ানোর পর ইমাম সাহেব উচ্চস্বরে পাঠ করেন আর ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়া ও আসার পথে এ তাকবির পাঠ করা উচিত। ঈদের পূর্বে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, শিশু এমনকি সদ্য জন্মলাভকারী শিশুর জন্যও নির্ধারিত ফিতরা আদায় করা জরুরি। ফিতরার টাকা দিয়ে গরিব, অসহায় দুস্থগণ অন্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করে থাকে। যেহেতু ফিতরার টাকা দিয়ে দুস্থ অসহায়গণ ঈদ করে তাই ঈদের কিছুদিন আগে এই টাকা আদায় করা সবচেয়ে উত্তম। এ ফিতরা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করা উচিত। কেননা গরিব রোজাদার যেন ফিতরার অর্থ দিয়ে ঈদের খুশিতে অংশগ্রহণ করতে পারে। ফিতরা দেওয়া কারও ওপর কোনো প্রকার অনুগ্রহ নয়। এটা আমাদের জন্য ইবাদতের অংশ। এমনকি যে ব্যক্তিকে ফিতরার সাহায্য দেওয়া হয়, তার নিজের পক্ষ থেকেও ফিতরা দেওয়া কর্তব্য। সবার অংশগ্রহণের ফলে সদকাতুল ফিতরের ফান্ডটি একটি সাধারণ ফান্ডে পরিণত হয়। যার ফলে এ থেকে যারা উপকৃত হয় তাদের মনে হীনম্মন্যতার ভাব সৃষ্টি হয় না। মূল বিষয় হলো ফিতরা আদায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের গরিব ভাইদের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব করতে পারি এবং তাদেরকেও ঈদের আনন্দে অন্তর্ভুক্ত করি। যাদেরকে আল্লাহতায়ালা ধন-সম্পদ দিয়েছেন তারা আল্লাহর রাস্তায় এবং গরিব অসহায়দের প্রতি যতই দান করুক না কেন এতে কিন্তু তার ধন-সম্পদে কমতি দেখা দেবে না বরং বৃদ্ধি পেতে থাকবে। ঈদের অনুষ্ঠান সাধারণত খোলা আকাশের নিচে অথবা জামে মসজিদে হয়ে থাকে। আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.) ঈদগাহ যাওয়ার জন্য ভিন্ন রাস্তা ও ফিরে আসার জন্য ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতেন যেন অনেক বেশি লোকের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং যেন তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া যায়। আমরাও এ কাজটি করতে পারি, আর এর ফলে সবাইকে ঈদের আনন্দে শামিল করা যাবে। এছাড়া ঈদের দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সম্ভব হলে নতুন পোশাক পরিধান করে ঈদগাহে উপস্থিত হতে হয়। পবিত্র ঈদ উপলক্ষে ঈদের উপহার বিতরণ করা মুসলমানদের মধ্যে চালু হয়ে আসছে। ঈদের খুশিতে আত্মীয়-অনাত্মীয় পরস্পরকে তোহফা বিনিময় করে থাকে এটা একটি ভালো রীতি। এতে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়, ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সুদৃঢ় হয়। কাপড়-চোপড়, দ্রব্যাদি, টাকা-পয়সা ঈদের তোহফা হিসেবে বিতরণ করা হয়ে থাকে। অনেকে তৈরি খাবার, মিষ্টি বিতরণ করে থাকে। ঈদের নামাজের মাধ্যমেই ঈদের প্রকৃত আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঈদের সব প্রস্তুতি মূলত আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যে শোকরানাস্বরূপ দু’রাকাত নামাজ পড়ার মাধ্যমে। সবার দিকে খোলা মাঠে অথবা মসজিদে এই দু’রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। ঈদের নামাজে আজান ও আকামত নেই। দু’রাকাত নামাজে সর্বমোট ১২টি তাকবির দিতে হয়। ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য মূলত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কৃতজ্ঞতা আদায় করা। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিল করে তারই ইবাদতের মাধ্যমে শোকরানা আদায় করে এটাকে বাস্তবে প্রকাশ করা। তাই এই আনন্দ শুধু খুশি বা মজার জন্য নয় বরং আপন প্রভুর বান্দা হিসেবে স্থায়ীভাবে ইবাদত প্রতিষ্ঠায় রত থাকা।আমরা যেন ঈদের আনন্দে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে সর্বদা জীবনের জন্য স্থায়ী ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে নেই।আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সদা সর্বদা তার শোকরানা আদায় করার তৌফিক দিন।ঈদুল ফিতরে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্বের মেলবন্ধন রচিত হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। ঈদ ধনী-গরীবের মাঝে বৈষম্য দূর করে সাম্যের কথা বলে। ঈদে শুধুই দামি পোশাকে বিলাসীতা না করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, শ্রেনী-পেশা দলমত নির্বিশেষে আসুন আমরা আর্তমানবতার পাশে দাঁড়াই। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সাম্য, মৈত্রী, সহমর্মিতা, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হই। শুধু নিজেকে নিয়ে না ভেবে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন এবং গরীব-দুঃখীদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করলে ঈদ হয়ে উঠতে পারে সবার জন্য সমান আনন্দের।আত্মশুদ্ধি, ন্যায় পরায়ণতা আর সংযমের মহান শিক্ষা নিয়ে বিশ্বমানবতার মাঝে শুভাগমন ঘটেছিল মাহে রমজানের। দাম্ভিকতার জিঞ্জির গুঁড়িয়ে, অন্যায়-অপরাধের পাহাড় মাড়িয়ে, আত্মপ্রতারণার পারদ গলিয়ে এক পরিশুদ্ধ-মানবিক মানুষ হওয়ার জন্য বারংবার আহ্বান জানিয়েছে রমজানের রোজা। ভেদাভেদ ভুলে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করে অনাবিল আনন্দের ঈদ উদযাপনের মাঝে বৈচিত্র্যের অন্যন্য এক নজির স্থাপন তারই অবদান। এই ঈদে আমার আশা থাকবে রমজানের মহান ব্রতপালন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রত্যেকেই ধর্ম-বর্ণ, জাতি গোষ্ঠী নির্বিশেষে হয়ে উঠবে একজন প্রকৃত মানুষ। আর কোনো চিকিৎসক না হয়ে উঠুক সমাজের চোখে কসাই, প্রকৌশলী না হোক লালায়িত প্রতারক, সরকারি কর্মকর্তা না হোক ঘুষখোর আর দায়িত্বজ্ঞানহীন, বিত্তশালীর রক্তচক্ষু হোক অবনত, গণমাধ্যমকর্মী হোক সত্যের পথে অটুট, দিনমজুর-খেটে খাওয়া মানুষ পাক সকলের সাথে প্রাণখুলে হাসার অধিকার, সকলের নিজ প্রাণ হোক উজ্জীবিত-হোক পরিশীলিত। কয়েকবছর আগেও ঈদ পালনে সবার মাঝে দেখা যেত আন্তরিকতার ছোঁয়া।কিন্ত বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে আমরা এতটাই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছি যে পরিপূর্ণভাবে সবাই মিলে ঈদ আনন্দ গ্রহণ করতে পারছি না। ঈদের আনন্দগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে অনুভূতিহীন আর কৃত্রিমতার। আমাদের জীবনে সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আবার ফিরে আসুক।ফিরে আসুক সেই আনন্দঘন,শান্তি,সৌন্দর্য মিশ্রিত ঈদ। ঈদের সৌন্দর্য রক্ষায় প্রতিবারের মত এই ঈদেও গরীব, অসচ্ছল ও স্বল্প আয়ের মানুষের মুখে ঈদের হাসি ফোটানোর দায়িত্ব আমাদেরই। ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হোক কোনো পথ শিশু। আমরা চাইলেই আমাদের নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারি ঈদের আনন্দ। ঈদ পালিত হয় সেই পুরোনো রূপে; আনন্দের মহোৎসবে। তাই বিপুল যাত্রীর বাড়ি ফেরা, ঈদ উদ্যাপন এবং আবার কর্মস্থলে ফেরার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাত্রাপথের ভোগান্তি কমাতে এবং পরিবহনব্যবস্থার সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও যাত্রীদের আন্তরিক হতে হবে। ঈদ ঘিরে সব ধরনের অপরাধ ও শান্তি বিনষ্টকারী অপচেষ্টা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি-বেসরকারি জরুরি সেবা কার্যক্রম যেন কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং ঈদ-পরবর্তী পর্যটন কেন্দ্রগুলোর শৃঙ্খলা-নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এবারের ঈদে আমাদের একান্ত প্রত্যাশা-রাষ্ট্র ও সমাজ সব সমস্যা-সংকট কাটিয়ে উঠুক। মজবুত হোক আমাদের জাতীয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল-মতের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের অটুট বন্ধন। সহনশীলতা, সহাবস্থান ও পরমত সহিষ্ণুতার চর্চা হোক সমাজের সর্বত্র। ঘুচে যাক ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু ও ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীনের ফারাক। ঈদের আনন্দে ধুয়ে-মুছে যাক সব দুঃখ-গ্লানি। ঈদ-আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। ঈদুল ফিতর যে আনন্দের সওগাত নিয়ে এসেছে, তা সব মানুষের ঘরে অর্থবহ হোক। আনন্দের সঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার তৌফিক সবার হোক-এই প্রত্যাশাই করি। ঈদ আমাদের সামষ্টিক জীবনে সম্প্রীতি ও শুভবোধের চর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক, মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান ঘটাক,এই কামনাই করি। ঈদ সবার জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। সবাইকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |