 / মতামত / ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত ও গাজায় চলমান গনহত্যা
ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত ও গাজায় চলমান গনহত্যা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
Published : Friday, 4 April, 2025 at 7:05 PM
|
 যুদ্ধবিরতীর শর্ত ভেঙ্গে গাজায় ইসরাইলী গণহত্যা নতুন মাত্রায় উপনীত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা অর্ধলক্ষ অতিক্রম করেছে। নির্বিচার বোমা হামলায় একরাতে শত শত ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদের হত্যার পর ইয়েমেনের হুতি, গাজার আল কাসসাম ব্রিগেড ও লেবাননের হিজবুল্লাহ ও সরকারি বাহিনী সমান্তরালভাবে ইসরাইলে প্রত্যাঘাত শুরু করেছে। দখলদার জায়নবাদী ইসরাইলের ১৫ মাসব্যাপী বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর বিভীষিকা জয় করে হামাস ও গাজার নিপীড়িত জনগণ শত্রুর মুখে বিদ্রুপের ছাই দিয়ে অজেয় স্ফীংস পাখির মত টিকে থাকা গাজানদের প্রতি জায়নবাদী ইসরাইলীদের পৈশাচিক আক্রোশ এখন বিশ্বের সামনে উলঙ্গভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। গাজা উপত্যকায় ওয়াশিংটন বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। যখন ইসরায়েল গাজার ছিটমহলের কয়েক ডজন লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের সময় নির্ধারণ করে, সেই মুহূর্তটি ছিল সাহরির সময়। প্রায় ১০০টি পৃথক স্থানে একযোগে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করা হয়। গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা যুদ্ধ ইসরায়েলি বাহিনীর সবচেয়ে জঘন্য হত্যাকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, ১৭০ জনের বেশি শিশুসহ ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি হয়েছে।ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলা চালানোর আগে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সবুজসংকেত চেয়েছিলেন এবং তা পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এভাবে আন্তর্জাতিক নেতাদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতিটি দিক লঙ্ঘন করে আক্রমণের মাধ্যমে বৈশ্বিক বিষয়ে নতুন যুগের সূচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র যে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি রাখে ট্রাম্প তা দেখিয়ে দিচ্ছেন।একজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, যিনি মিশিগানের ইমামদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি একজন শান্তিপ্রিয় মানুষ।এমনকি পরবর্তী নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। তিনি এখন ইহুদি গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে, যারা তাদের রাজনৈতিক অপবাদ দিয়ে ফিলিস্তিনি লেবেল ব্যবহার করছেন। যে রাষ্ট্রপতি সব যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি ইয়েমেন, গাজা, লেবানন এবং সিরিয়ায় আবার বিমান হামলা শুরু করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, ইরান যদি তার দাবি মেনে না নেয়, তবে আরও কঠিন বিপদ হবে। একজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট; যিনি জিম্মিদের পরিবারকে বলেছিলেন, তিনি তাদের জীবিত ফিরিয়ে আনার জন্য তার ক্ষমতার সবকিছু করবেন। তিনি ইসরায়েলকে এই হামলার আগে দুই ডজনের ওপর কার্যকরভাবে তার হ্যানিবল নির্দেশিকা প্রয়োগ করার অনুমতি দিয়েছেন। যদি ইসরায়েল এ রকম আচরণ করে তাহলে এখন বাকি জিম্মিদের জীবিত রাখার জন্য হামাসকে কী বলবে? নেতানিয়াহুর কাছে এই হামলার সময়টাই সবকিছুর ভিন্ন কারণ ছিল। সম্প্রতি একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে তার হাজির হওয়ার কথা ছিল, যা মামলার অগ্রগতির দিকে এগিয়ে তার রাজনৈতিক শক্তিকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারত। নতুন করে যুদ্ধ আদালতে জবাবদিহির বিষয় ছিল। কিন্তু তিনি অজুহাত দিয়েছেন, আদালতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। নেতানিয়াহুর অর্থমন্ত্রী এবং চরমপন্থি ধর্মীয় জায়নিস্ট পার্টির নেতা বেজালেল স্মোট্রিচ যখন বিশ্বকে বলেছিলেন, নেতানিয়াহু গাজায় যুদ্ধ পুনরায় শুরু করবেন, তখন তিনি ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু ধর্মীয় ইহুদিবাদীদের জন্য যারা কাজ করছে তারা এখন ইসরায়েলের একক সবচেয়ে শক্তিশালী দল। ঈশ্বরের প্রতিশোধের সেনাবাহিনীই হলো গাজা অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। তারা ভূমিসংক্রান্ত বিরোধকে ধর্মীয় যুদ্ধে পরিণত করার জন্য তাদের ক্ষমতার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। বছরের পর বছর তারা রমজান মাসে আল-আকসা মসজিদে মুসল্লিদের ওপর আক্রমণ করতে পুলিশকে চাপ দিয়েছে। ফলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণ শুরু হয়, যাকে দলটি অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড নামে অভিহিত করে। যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য দেশে হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ শত্রুও ধর্মীয় উৎসবের সময় যুদ্ধ বন্ধ করতে রাজি হয়। কিন্তু ইসরায়েল কেবল তাদের স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি থেকে সরে আসেনি; তারা বিশেষভাবে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য সমবেত উপাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছে।ইসরায়েল যদি মুসলিমবেষ্টিত অঞ্চলে ছোট বসতি স্থাপনকারী-ঔপনিবেশিক শক্তি হয়, তাহলে এই সংঘাতকে ধর্মীয় সংঘাতে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা আত্মঘাতী হবে। সব মুসলিমের অন্তরে যে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা নেভানো কঠিন হবে।এই আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য দুটি রাজ্য অথবা একটি রাজ্যে ইসরায়েলি ইহুদিদের সঙ্গে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে হামাসের পদক্ষেপ সত্ত্বেও বেশির ভাগ সামরিক বিশ্লেষকের মতে, হামাস এখনো একটি সুশৃঙ্খল মিলিশিয়া, যারা স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো মেনে চলে। ইসরায়েল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত চুক্তি একাধিকবার লঙ্ঘন করে অশান্ত সন্ত্রাসী বাহিনীর মতো আচরণ করছে। এই হামলার আগে যুদ্ধবিরতি চলাকালীন গাজায় ইসরায়েল ১৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। চুক্তিতে উল্লিখিত প্রথম পর্যায়ের ১৬তম দিনেও দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়ে আলোচনা শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলাডেলফি করিডর থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি পূরণ ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি এক সপ্তাহের বেশি সময় বিলম্বিত করেছে।ইসরায়েল মাফিয়ার মতো আচরণ করছে। গাজাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চুক্তিতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে। তারা একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা স্টিভ উইটকফের কাছ থেকে এসেছে। যদিও ট্রাম্পের দূতের কাছ থেকে কোনো সমর্থন আসেনি। তারা দাবি করেছে, হামাস ৫০ দিনের যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ১১ জন জীবিত জিম্মি এবং আহতদের মুক্তি দেবে। এটি কাতার এবং মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে আলোচনা করা চুক্তির চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। মারিভের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই আকস্মিক হামলার পরিকল্পনা সেনাবাহিনী এবং শিন বেটের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা। লক্ষ্য ছিল প্রথম হামলায় যত বেশি সম্ভব হামাস সদস্যকে লক্ষ্যবস্তু করা, ঠিক যেভাবে লেবাননে যুদ্ধের শুরুতে এটি হিজবুল্লাহর সিনিয়র কমান্ডকে অক্ষম করে দিয়েছিল।মারিভের মতে, মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো গাজাও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রমজানের জন্য তাদের সময়সূচি পরিবর্তন করেছে। শিন বেট এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা হামাস সদস্যদের উপস্থিত থাকা এবং সেহরি খাবারের আয়োজনের সময় সেই স্থানগুলোতে অবস্থান করার কথা ছিল। শিন বেট এবং ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর লক্ষ্য ছিল আক্রমণের প্রথম ধাপে কয়েক ডজন যুদ্ধযান দিয়ে একসঙ্গে গাজায় হামাস সদস্যদের অবস্থানস্থলে শত শত বোমা নিক্ষেপ করা, যা রাত ২টা ২০ মিনিটে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বিমান হামলায় কতজন হামাস নেতা নিহত হয়েছেন, তা এখনো জানা যায়নি। তবে এ ধরনের আক্রমণ সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। সাংবাদিক প্যাট্রিক ম্যাগুয়ার এবং গ্যাব্রিয়েল পোগ্রান্ড তাদের বই ‘গেট ইন’-এ উভয় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। যেখানে লেবার নেতার ক্ষমতায় উত্থানের ক্ষেত্রে স্টারমারের ম্যাকিয়াভেলিয়ান আইরিশ বংশোদ্ভূত ফিক্সার মরগান ম্যাকসুইনির প্রভাবের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। স্টারমার নিক ফেরারির সঙ্গে এলবিসিতে তার সাক্ষাৎকারের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানান। যেখানে তিনি বলেছিলেন, গাজা থেকে পানি এবং বিদ্যুৎ বন্ধ করার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে। অবশেষে তিনি একটি স্পষ্টীকরণ জারি করে বলেন, তিনি ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কে একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ আরও তীব্র হতে থাকে। ম্যাগুইর এবং পোগ্রান্ডের মতে ল্যামি, কুপার, নন্দি, মাহমুদ এবং স্টারমারকে তার সুর পরিবর্তন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। স্টারমারের উপদেষ্টারা নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিলেন, ম্যাকসুইনি সর্বদা এই সম্ভাবনাকে গ্রহণ করেছিলেন যে, লেবার পার্টি লাখ লাখ ভোটারকে হারাতে পারে, যারা জেরেমি করবিনের অধীনে দলকে সমর্থন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। স্টারমারের অফিসের দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছায়া মন্ত্রিসভার একজন সদস্য লেখকদের বলেন, তারা ফিলিস্তিনি সক্রিয়তাকে অতি বামপন্থিদের একটি সৃষ্টি হিসেবে দেখেন।এই দৃষ্টিভঙ্গি আজও বহাল আছে।স্টারমার প্রকাশ্যে তার পররাষ্ট্র সচিবকে অবজ্ঞা করেন, যখন ল্যামি ইসরায়েলকে পূর্ণ অবরোধ আরোপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। ফলে গাজার ২৩ লাখ মানুষের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।নেতানিয়াহু যদি তার আকস্মিক আক্রমণ শুরু না করতেন তাহলে স্টারমার ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সারকে যুক্তরাজ্যে উষ্ণভাবে আলিঙ্গন করতেন। এমনকি পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক নির্বাচন কমিটির সভাপতি এমিলি থর্নবেরির প্রতি ইসরায়েল অবমাননাকর আচরণ করার পরও এমনটা করতেন। ইসরায়েলের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্যারেন হাসকেল গোপনে তার ভিডিও ধারণ করেন এবং ফুটেজটি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন। তিনি ছিলেন গাজায় পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ভোট দেওয়া মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। তিনি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের একজন ঘোর বিরোধী। গত নভেম্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘আজ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তৈরি করা হামাস রাষ্ট্র তৈরির সমতুল্য হবে।’ স্টারমারের ব্রিটেন গাজায় ইসরায়েলকে গণহত্যা করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সহযোগী। এতে আন্তর্জাতিক আইনের পবিত্রতা শব্দটির আর কোনো অর্থ রইল না। কিন্তু এখানেই গল্পের শেষ নয়, এমনকি স্টারমারের ক্ষমতা থেকে উত্থান-পতনের গল্পেরও শেষ নয়। হামাস এমনকি গাজার ফিলিস্তিনিরাও দ্রুত এবং সুবিধাজনকভাবে বিলুপ্ত হবে না। স্টারমারের জন্য গাজা এখনো তেমনই হতে পারে, যেমনটি ইরাক যুদ্ধ তার পথপ্রদর্শক এবং পরামর্শদাতা টনি ব্লেয়ারের জন্য প্রমাণিত হয়েছিল। ইসরাইলের আগ্রাসন, দখলবাজি ও গণহত্যার বিরুদ্ধে ইরান সমর্থিত প্রতিরোধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মোকাবেলা করতে চাইছে। আপাত দৃশ্যে এটি ইরানের সাথে যুদ্ধ বলে শিয়া-সুন্নি বিরোধ উস্কে দিতে চাইলেও আদতে এটি ক্রুসেডের ধারাবাহিকতা এবং জেরুজালেমের উপর দখলদারিত্ব চিরস্থায়ী করার মহাপরিকল্পনার অংশ। জায়নবাদীদের আরোপিত শিয়া-সুন্নি বিরোধ ভুলে এই যুদ্ধে মুসলমানদের ঐক্য না হলেও ইসলামি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিজয় হবে। গাজা যুদ্ধে তারই প্রতিফলন দেখা গেছে। এবার ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিনী পরিচালিত ইসরাইলী যুদ্ধ শুরু হলে ইসরাইলের পতনের মধ্য দিয়ে এবার ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও আল আকসার মুক্তি ঘটতে পারে। সেখানে আরবদের ঐক্য ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |
