বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী আর অর্ধশতাধিক খাল নিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যে গড়ে উঠেছিল, আজকের ঢাকা শহর। কালের স্রোতে এসব দৃষ্টিনন্দন নদী-খাল আর মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বান্ধব নগরী আজ দূষিত শহরে রূপ নিয়েছে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে সবাই বড়লোক হওয়ার ধান্ধাই থাকে। যার ফলে নদী-খাল ভরাট করে গড়ে তুলেছে অসংখ্য ঘর-বাড়ী, শিল্পকারখানা আর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান। এ শহর নানান কারণে দূষিত হচ্ছে, তন্মধ্যে- বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, নদী-খাল দূষণ, প্লাস্টিক-পলিথিন দূষণ, পানি দূষণ, বর্জ্য দূষণ, জলাবদ্ধতা, ঘনবসতি অন্যতম। পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকার কারণে দিনদিন কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর অক্সিজেন কমছে। কারণ গাছ- কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে আর অক্সিজেন দেয়। একটি শহরের ১০-১২ শতাংশ জলাভূমি থাকতে হয়। ঢাকায় ৩ শতাংশও নেই। সবুজ থাকতে হয় ১৫ শতাংশ, আছে ৭ শতাংশের কম। ঢাকায় ৩ শতাংশ গাছ রয়েছে। যদিও এটি ৭ শতাংশ থাকার কথা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, মন্ত্রীপাড়া, বলদা গার্ডেন, জিয়া উদ্যান (চন্দ্রিমা উদ্যান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু কিছু জায়গায় সবুজায়ন রয়েছে। ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরে মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ এবং পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ-আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। কালো ধোঁয়া নির্গমণকারী যানবাহনের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এতে বাড়ছে বায়ুদূষণের মাত্রা। অথচ যানবাহনের কালো ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা নিঃশ্বাসে যে বায়ু নিচ্ছি তা নির্মল না। কারণ বাতাসে আছে জনস্বস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অনেক পদার্থ; যা খালি চোখে দেখা যায় না। আর এই বায়ু দূষণের জন্য অনেকটাই দায়ী যানবাহনের কালো ধোঁয়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাতাসকে দূষণে ভারি করে তুলছে যানবাহনের ধোঁয়া। বায়ুদূষণের জন্য এখন ৫০ ভাগ দায়ী মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়া। আর এই তালিকায় আছে বাস, লেগুনা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাস। বিশেষ করে, মেয়াদ উত্তীর্ণ এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহন থেকেই বের হচ্ছে, কালো ধোঁয়া; যা বিষাক্ত ধোঁয়া। বাংলাদেশে যে হারে ব্যক্তিগত গাড়ী এবং এসির ব্যবহার হয়, উন্নত বিশ্বে এত পরিমাণ গাড়ী এবং এসির ব্যবহার নাই বললে চলে। এজন্য ঢাকার তাপমাত্রা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাড়ীর হর্ণের শব্দদূষণ তো নিত্যদিনের ঘটনা। আজকালকার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পলিথিন এবং বর্জ্য আগুনে পুড়ানোর কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় বায় দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। যার ফলে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। ঢাকার মীর হাজীরবাগ, জুরাইন, ধোলাইপাড়, ধোলাইখাল, নবাবপুর এরিয়াতে ইস্পাত, প্লেট, সিট, লোহাজনিত জিনিস পত্র বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গলানো, পুড়ানো এবং কাটানোর ফলে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ এবং শব্দদূষণ হচ্ছে। ঢাকা কাকের শহর। গ্রামের মানুষের যেমন ঘুম ভাঙে মোরগের ডাকে, তেমনি ঢাকাবাসীর ঘুম ভাঙত কাকের ডাকে। শহরের আনাচে-কানাচে এই পাখির সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো ছিল একটি সময়। কিন্তু নানা কারণে এখন ঢাকায় কমছে কাকের সংখ্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যের সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং নির্মম আধিপত্যের আধিক্যের কারণে আগের মতো জন্মাচ্ছে না নগরপক্ষী চিরচেনা কাক। কাক ময়লা আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে; কিন্তু দূষণ এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, কাকও ঢাকা শহরে বসবাস করতে পারছেনা। মিরপুুরসহ ঢাকা শহরের নানান জায়গায় ডাইং কেমিক্যাল শিল্পকারখানা গড়ে উঠার কারণে প্রতিনিয়ত নদী ও খালের পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত হয়ে পানি দূষিত হচ্ছে। ঢাকাকে এক নজরে দেখলে মনেহয়; এটি কোন রাজধানী নয়; বরং এটি একটি শিল্প অঞ্চল বা অথনৈতিক জোন। বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের রাজধানীতে এত পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠান দেখা যায়না। সরকার ও জনসাধারণের উচিত, ঢাকা শহরকে দূষণ মুক্ত করা; প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। অন্যথায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে এবং একটি সময় ঢাকা শহর মৃত্যুপুরী বা অস্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে বিশ^ দরবারে প্রথম স্থান অধিকার করবে। আসুন, আমরা পরিবেশ বান্ধব ঢাকা শহর গড়ে তুলি; এটি হোক তারুণ্যের স্লোগান।
কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী: পরিবেশ কর্মী ও ব্যাংকার
|