![]() বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য: টানাপড়েনে ক্ষতিগ্রস্ত কারা?
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() যদিও বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেছেন, ভারত হঠাৎ করে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল করলেও বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। তবে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহন খরচ দুই হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আমরা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছি তাতে এ খরচ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে একসময় মাইনাস টাকায়ও নিতে পারবো। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমরা সংকট কাটানোর চেষ্টা করবো। অবশ্য ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল ইস্যুতে বৃহস্পতিবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন, ভারতের বন্দরগুলোতে যানজট তৈরি হচ্ছে। ওই জট কাটাতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ট্রান্সশিপমেন্ট হলো- এমন একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া, যেখানে একটি দেশ তার পণ্য সরাসরি গন্তব্য দেশে না পাঠিয়ে মাঝপথে অন্য একটি দেশের বন্দর ব্যবহার করার মাধ্যমে রপ্তানি করে। একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পণ্য আমদানিও করা হয়। ২০২০ সালের ২৯শে জুন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি হয়। কিন্তু গত ৮ই এপ্রিল একতরফাভাবে সেই চুক্তি বাতিল করে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি)। কতটা ক্ষতি হবে বাংলাদেশের? বিশ্লেষকরাও বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের তেমন কোনো সমস্যা হবে না। কারণ, বাংলাদেশ এই সুবিধা খুব বেশি ব্যবহার করতো না। তাছাড়া, বাংলাদেশ ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানেই বেশি পণ্য রপ্তানি করে। ভারত বলেছে, এই দুই দেশে পণ্য রপ্তানিতে ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের প্রভাব পড়বে না। মূলত, ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহার করে ইউরোপ-আমেরিকায় তৈরি পোশাকসহ ‘সামান্য কিছু পণ্য’ রপ্তানি করতো বাংলাদেশ। এখন সেই সুবিধাটুকুই বন্ধ। কার্গো বন্ধের প্রভাব ঢাকা থেকে ইউরোপগামী এয়ার কার্গোর স্পট রেট কেজিপ্রতি ৬.৩০ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৫০ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে এখন কেজিপ্রতি ৭.৫০ থেকে ৮ ডলার গুনতে হচ্ছে, যেখানে ২০২৪ সালের আগস্টে এই রেট ছিল ৬.৯১ ডলার। অন্যদিকে কলকাতা থেকে কেজিতে এই খরচ মাত্র ৪ ডলার এবং মালদ্বীপ থেকে ৩.৫০ ডলার। রপ্তানিকারকদের এখন বাড়তি চার্জও গুনতে হচ্ছে। এসব চার্জের মধ্যে রয়েছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য কেজিতে ২.৫০ টাকা, স্ক্যানিংয়ের জন্য কেজিতে ২ টাকা, আর ওয়্যারহাউজ স্টোরেজের ভাড়ার জন্য কেজিতে দৈনিক ২৫ পয়সা। টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, ব্যবসা পরিচালনার খরচ বেড়ে যাবে, লিড টাইম বাড়বে, এবং আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে আসবে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার বলেন, ইইউতে কেজিতে প্রায় ৬ ডলার খরচে পণ্য পাঠাতে পারছেন। কিন্তু ফরোয়ার্ডাররা জানিয়েছেন, খরচ আরও বাড়বে। সরকার যদি অবিলম্বে বাড়তি কার্গো সার্ভিস চালু না করে এবং বিমানবন্দরের জট না কাটায়, প্রধান বাজারগুলো থেকে আমরা ছিটকে পড়বো। কারা লাভবান আর কারা ক্ষতিগ্রস্ত? মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সুতা আনা বন্ধ হবে। এতে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা পাবে। আবার ভারত থেকে সমুদ্রপথে সুতা আমদানি করলে আর্থিকভাবে লাভ হবে। আবার স্থলপথের চেয়ে সমুদ্রপথে সময় খুব বেশি লাগবে না। ভারত থেকে সুতা আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও কম মূল্যে সুতা রপ্তানির অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ স্থলসীমান্তে বাংলাদেশ কাস্টমসে যে পরিমাণ সুতা আমদানির কথা বলা হয়, এর চেয়ে বেশি সুতা দেশে আসে। লোকবলের অভাবে সশরীরে পরিদর্শন করার সক্ষমতা কম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। এই সুযোগে ৩০ কাউন্টের সুতার চালানের ভেতরে ৮০ কাউন্টের সুতা আনার অভিযোগও আছে। সুতার সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা পরিমাপ হয় কাউন্ট দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশের স্থলবন্দরে সুতার সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা মাপার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। কয়েক বছর আগে বেনাপোল স্থলবন্দরে সুতার সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা পরিমাপের জন্য যন্ত্রপাতি বসালেও দুই মাসের মাথায় তা অকেজো হয়ে যায়। জানা গেছে, ভারতের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট থেকে বাংলাদেশে সুতা আসে। সড়কপথে সুতা আসতে ১০-১২ দিন সময় লাগে। অন্যদিকে, চেন্নাই সমুদ্রবন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আসতে সময় লাগে দুই সপ্তাহের মতো। আর সমুদ্রপথে পণ্য এলে তিন-চারদিন বেশি সময় লাগে। কিন্তু জাহাজে সুতা আনলে ভাড়া ১০ শতাংশ কম পড়ে। ভারত হয়ে কতো কার্গো যেতো? ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও পোশাক রপ্তানিকারকদের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সাপ্তাহিক এয়ার কার্গোর প্রায় ১৮ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৬০০ টন, ভারতের বিমানবন্দর দিয়ে পরিবাহিত হতো। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৬২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৩৪ হাজার ৯০০ টনের বেশি পোশাকপণ্য ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৩৬টিরও বেশি দেশে পাঠানো হয়। বাংলাদেশের কার্গো হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা সীমিত। ২০২৪ সালে এই বিমানবন্দরে প্রায় ২ লাখ টন রপ্তানি পণ্য এবং প্রায় ৫০ হাজার টন আমদানি পণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়। এসব পণ্য বহনকারী প্রধান এয়ারলাইনের মধ্যে রয়েছে- এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, টার্কিশ, সৌদিয়া, ইতিহাদ ও বিমান বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কম এবং কার্গো চাহিদা কম থাকায় দেশের বাকি দু’টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর- সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর-নগণ্য পরিমাণ কার্গো হ্যান্ডলিং করেছে। সমাধান কিভাবে? বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম মনে করেন, দ্রুততম সমাধান নির্ভর করছে ঢাকা বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু করা এবং স্বল্পমেয়াদে কোনো তৃতীয় পক্ষের অপারেটরকে নিয়োগ দিয়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের উপযুক্ত করে তোলা। তিনি বলেন, থার্ড টার্মিনাল পুরোপুরি চালু হলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তিন গুণ হয়ে বছরে ৫.৪৭ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। ঢাকা বিমানবন্দরের তিনটি স্ক্যানিং মেশিনের মধ্যে একটা প্রায় সবসময়ই অকেজো থাকে। মেশিনটি জরুরি ভিত্তিতে ঠিক করা দরকার। উল্লেখ্য, স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ করার দাবি অনেক দিনের। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে অন্যতম বস্ত্র খাতের অন্যতম কাঁচামাল সুতা আমদানি বন্ধের দাবি জানায় বস্ত্রশিল্পমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশন (বিটিএমএ)। |