![]() উত্তেজনার বিস্ফোরণ: ভারত কি এবার সত্যিই আক্রমণ করবে?
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক ডজনেরও বেশি দেশের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং দিল্লিতে অবস্থিত শতাধিক কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছেন। যদিও এমন পদক্ষেপ সাধারণত আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইতে নেওয়া হয়, তবে চারজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ভারতের প্রচেষ্টা আসলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের যৌক্তিকতা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি ২৪ এপ্রিলের ভাষণে পাকিস্তানের নাম সরাসরি উল্লেখ না করলেও সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস ও কঠোর শাস্তির হুমকি দিয়েছেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েক রাত ধরে গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী কাশ্মীরে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করেছে এবং শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা এবং পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতের সাথে কাশ্মীর সীমান্তের যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্থগিত করেছে এবং নানা কূটনৈতিক চুক্তি পর্যালোচনার ঘোষণা দিয়েছে। দুই দেশের মধ্যে এমন পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ অস্বাভাবিক নয়, তবে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুতর বেশি। বিশেষ করে যখন দুই দেশের নেতৃত্বের মধ্যে কঠোর অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতে মুসলিমবিরোধী মনোভাবও এই সময় বেড়েছে। কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শহরে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। হামলার পাঁচ দিন পরও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের নাম ঘোষণা করেনি এবং পাকিস্তানের সম্পৃক্ততারও খুব কম প্রমাণ প্রকাশ করেছে। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা পাকিস্তানের অতীতের সন্ত্রাসী সম্পৃক্ততার ইতিহাস তুলে ধরছেন এবং প্রযুক্তিগত কিছু প্রমাণের কথা বলছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শক্ত প্রমাণের অভাব ভারতীয় কৌশলের দুটি দিক দেখায়; হয় ভারত তদন্ত সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছে, অথবা বর্তমান আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বিস্তারিত ব্যাখ্যা ছাড়াই পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত হচ্ছে। ভারতের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক চাপের তোয়াক্কা কমেছে। বিশেষ করে এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংকটে ব্যস্ত থাকায় ভারত তুলনামূলক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। ইরান ও সৌদি আরব উভয় পক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছে এবং ইরান মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংযমের আহ্বান জানালেও আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয়তা এখনো সীমিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন জানালেও কৌশলগতভাবে তারা এখন দক্ষিণ এশিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। উল্লেখযোগ্যভাবে, এখনও ভারতে কোনও মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যা ট্রাম্প প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়া নীতির গুরুত্বহীনতার ইঙ্গিত দেয়। ২০১৯ সালের কাশ্মীরের বড় হামলার সময়ের মতোই এবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া অনেকটা সতর্ক ও নিষ্ক্রিয়। তবে ২০১৯ সালে জইশ-ই-মুহাম্মদের নাম উঠে এসেছিল, যা এবার অনুপস্থিত। বর্তমানে হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ) নামে এক নতুন গোষ্ঠী, যাকে ভারতীয় কর্মকর্তারা লস্কর-ই-তৈয়বার ছায়া সংগঠন বলে সন্দেহ করছেন। হামলাকারীদের পরিচয় ও সংখ্যা নিয়েও এবার বেশ অনিশ্চয়তা রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। পরে এক বিবৃতিতে টিআরএফ জানিয়েছে, হামলাটিকে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে টিআরএফের ডিজিটাল চ্যানেলে একটি হামলার দায় স্বীকারের পোস্ট প্রকাশিত হয়েছিল।সংগঠনটি দাবি করছে, সাইবার আক্রমণের ফলে এটি হয়েছে। ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিব শঙ্কর মেননের মতে, মোদি সরকারের সামনে সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া তেমন কোনো বিকল্প নেই। ২০১৬ ও ২০১৯ সালে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়েছিল। ফলে এবারও জনগণের চাপ ও রাজনৈতিক প্রত্যাশার মুখে মোদি সরকার আগ্রাসী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতে পারে। বিশেষ করে তারা সম্প্রতি কাশ্মীরকে নিরাপদ ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করছিল, অথচ এই হামলা সেই প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সবশেষ নরেন্দ্র মোদি হামলার জবাব দিতে ভারতীয় বাহিনীকে ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’ দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে সেনাবাহিনী এখন নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবে। তবে পাকিস্তানও পাল্টা প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশটি ভারতের যেকোনো হামলার জবাবে বড় ধরনের প্রতিআক্রমণের হুমকি দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশই নিজেদের সামরিক সক্ষমতা অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করছে, যা পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে। পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী হানিফ আব্বাসী সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেন, ভারতের দিকে তাক করা আছে পাকিস্তানের ১৩০টি পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র। ঘোরি, শাহিন, গজনবি মিসাইল প্রস্তুত রয়েছে এবং যেকোনো ভারতীয় আগ্রাসনের জবাব দিতে তারা সর্বাত্মক প্রস্তুত। বিশেষ করে, যদি ভারত সিন্ধু নদের পানি বন্ধ করে দেয়, তাহলে পাকিস্তান যুদ্ধের পথে হাঁটবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। এই বক্তব্য দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মূল সমস্যা হলো, দুই দেশের অতীত ইতিহাস—কাশ্মীর নিয়ে তিনটি যুদ্ধ—দেখিয়েছে যে কাশ্মীর ইস্যুতে সংঘাত কখনোই ছোট পরিসরে আবদ্ধ থাকে না। উভয় দেশই কাশ্মীরের পুরো অংশ নিজেদের দাবি করে এবং পাকিস্তানের সাথে বিরোধকে ভারত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা হিসেবেই দেখে এসেছে। সুতরাং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ সীমিতই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। কৌশলগত জোটের দিক থেকে ভারত বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে রয়েছে রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইসরায়েল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্প্রতি বেড়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান ঐতিহ্যগতভাবে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং কিছু ক্ষেত্রে মার্কিন সমর্থন পেলেও তা সীমিত। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) পাকিস্তানের সামরিক ও অর্থনৈতিক সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে ভারত কোয়াড জোটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরি করছে। সব মিলিয়ে, ভারতের সামরিক প্রস্তুতি এবং পাকিস্তানের পাল্টা হুমকি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় সংঘাতের সম্ভাবনাকে উসকে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে একটি সামান্য ভুল হিসাব কিংবা ভুল বোঝাবুঝি বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হলো দ্রুত সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত করা, যাতে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় না পড়ে। তবে বর্তমান বাস্তবতায় তা কতটা সম্ভব হবে, সেটি নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। |